সোমবার ৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এই এপ্রিল এত ভয়ংকর কেন

বাংলাদেশ ডেস্ক   |   রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   10 বার পঠিত   |   পড়ুন মিনিটে

এই এপ্রিল এত ভয়ংকর কেন

প্রখর তাপপ্রবাহ আর গরমে ঘরে-বাইরে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। জনজীবন এক রকম বিপর্যস্ত। ঘর থেকে বের হলেই যেন মরুভূমির লু হাওয়া। অতিরিক্ত তাপে গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ। বছরের এই সময়ে মাঝেমধ্যে কালবৈশাখী ও বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি আনে; কিন্তু এবার তা-ও নেই। গত দুই বছরের মতো এবারও এপ্রিল মাস যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

একসময় রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগের একাংশে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম পড়ত। আর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে গরমের কষ্ট ছিল বেশি। গত ১০ বছরে দেশের ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়ে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত থেমে থেমে তাপপ্রবাহ বইছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও ভোগান্তি তৈরি করছে এ মাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে বয়ে যাওয়া অতি উষ্ণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, যা ‘ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার’ নামে পরিচিত। এ ধরনের উষ্ণ আবহাওয়া বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাণঘাতী দুর্যোগে রূপ নিতে শুরু করেছে।

এপ্রিলের এ সময়ে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে তা ৩৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে। গড়ে সারা দেশের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব স্কুল-কলেজ সাত দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ক্লাসও। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবীদের কালো গাউন পরার আবশ্যকতা শিথিল করা হয়েছে। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে জরুরি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। হাসপাতালে হিট স্ট্রোকের রোগীও বাড়তে পারে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চলতি মাসের বাকি সময়জুড়ে তো বটেই, মে মাসের প্রথম সপ্তাহ ধরে সারা দেশে থেমে থেমে তাপপ্রবাহ বয়ে যাবে। আর অতি উষ্ণ ও আর্দ্রতার বিপদ থাকতে পারে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত।

তাপমাত্রাবিষয়ক গবেষক ও ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ বলেন, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে শুধু তাপমাত্রার তীব্রতা দিয়ে মানুষের কষ্ট ও বিপদ বোঝা যাবে না। কোথাও তাপপ্রবাহ অর্থাৎ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না গেলেও বিপজ্জনক আবহাওয়া তৈরি হতে পারে। কোথাও যদি তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং আর্দ্রতা ৪০ শতাংশের বেশি হয় এবং বাতাসের প্রবাহ কম থাকে, তাহলে সেখানে অতি উষ্ণতার বিপদ তৈরি হতে পারে। এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশে এই অতি উষ্ণতার বিপদই তৈরি হচ্ছে।

এপ্রিল যেভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে

আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, গত ৬০ বছরে এপ্রিলের উষ্ণতা দ্রুত বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই মাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকায় তাপপ্রবাহ বইছে। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে কয়েক দিন পরপর একাধিক কালবৈশাখী, ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়। এতে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমে আসে। এবার বৃষ্টি ও বাতাস নেই বললেই চলে।
চার দিন ধরে দেশের ৭০ শতাংশ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে। আর গতকাল দেশের অন্তত ১২টি জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, এপ্রিল মাসে আর্দ্রতা বা বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ; কিন্তু এ মাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে তা ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে ছিল। গতকাল ঢাকার বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৮৯ শতাংশ।

পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঘোষণা করা হয়। আর তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর আর্দ্রতা ৩০-এর ওপরে গেলে একে বিপজ্জনক আবহাওয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রকাশ করা ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। প্রতিবেদনে অনুযায়ী, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে ওই গবেষণা করেন। গবেষণায় বলা হয়েছে, ওই উচ্চ গরমের সঙ্গে মানুষের শরীর খাপ খাওয়াতে পারছে না। এতে নানা ধরনের রোগবালাই বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। ওই উচ্চ তাপমাত্রা শহরে খাওয়ার পানি ও বিদ্যুতের সংকট তৈরি করছে। এ ছাড়া ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া এবং খরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মানুষের মেজাজ খিটখিটে হওয়া এবং সামাজিক অশান্তি তৈরির ক্ষেত্রেও ওই অতি উষ্ণতা ভূমিকা রাখছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এপ্রিল মাসের আবহাওয়া অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অন্যান্য কারণে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সময়ের জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও গবাদিপশুর সুরক্ষার জন্য দ্রুত পরিকল্পনা নিতে হবে।

কী করতে হবে

অতি উষ্ণতার বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞরা কৃষিতে অতিরিক্ত সেচের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে গবাদিপশুর জন্য অতিরিক্ত পানি ও ছায়ার ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিজাস্টার সায়েন্স ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘সাধারণত অতিরিক্ত গরমকে আমাদের এখানে সাধারণ আবহাওয়াজনিত সমস্যা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের সারা বছরে আঘাত হানা দুর্যোগগুলোর দিকে খেয়াল করি, যা মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করছে, যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও এপ্রিলের তাপপ্রবাহ আমাদের জীবনের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, মৃত্যু কমেছে। তাপপ্রবাহকেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দুর্যোগ হিসেবে দেখতে হবে।’

Facebook Comments Box

Posted ১০:২০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪

nykagoj.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

ক্যালেন্ডার

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
সম্পাদক
আফরোজা ইসলাম
কন্ট্রিবিঊটিং এডিটর
মনোয়ারুল ইসলাম
Contact

+1 845-392-8419

E-mail: nykagoj@gmail.com